ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার একটি সুন্দর ছোট দেশ বাংলাদেশ। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। রয়েছে সমুদ্র সৈকত, প্রবাল দ্বীপ, পাহাড়, নদী, বন, পার্ক সহ ঐতিহাসিক বহু স্থাপনা ও নিদর্শন। দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু বহু পর্যটক সারাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন সারাবছর ধরে। তবে বাংলাদেশের পর্যটন ক্ষেত্রে এখনও তেমন উন্নত হয়নি। এখানে ঘুরে দেখার মতো অনেক সুন্দর জায়গা থাকলেও এটি বিশ্বের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। ভ্রমন কেন্দ্রগুলিতে দেশীয় পর্যটকের যথেষ্ট সমাগম হলেও বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কম। অন্তত পরিসংখ্যান তো তাই বলে। যদিও এখানকার লোকেরা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও অতিথিপরায়ণ। তারা সর্বত্র পর্যটকদের স্বাগত জানায় এবং তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করে।
একটি দেশের সেরা জায়গাগুলির একটি তালিকা তৈরি করা সর্বদা খুব শক্ত এবং বিতর্কিত একটি বিষয়। তবে বাংলাদেশের অসংখ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১০ টি’র কথা আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। সময় ও সুযোগ হলে, আপনিও ঘুরে আসতে পারেন দারুন ঐসব জায়গাগুলো থেকে।
১. কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। পাহাড়ঘেরা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এর রূপ পরিবর্তন হয়। ১২০ কিঃমিঃ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এ সমুদ্র সৈকতের প্রধান বৈশিষ্ট হলো পুরো সমুদ্র সৈকতটি বালুকাময়। চট্টগ্রামের ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত, এই জায়গাটির নামটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হীরাম কক্সের কাছ থেকে পেয়েছে।
প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক কক্সবাজারে ভ্রমণে আসেন। কক্সবাজার সৈকতে গেলে দেখা যায় অভাবনীয় দৃশ্য, হাজার হাজার নারী-পুরুষ শিশুর অপূর্ব মিলনমেলা। তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে মুখরিত সাগর তীর। সৈকতে রয়েছে, শামুক ঝিনুক সহ নানা প্রজাতির প্রবাল সমৃদ্ধ বিপণি বিতান। রয়েছে অত্যাধুনিক হোটেল মোটেল কটেজ, নিত্য নব সাজে সজ্জিত বার্মিজ মার্কেট সমূহ।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ছাড়াও ইনানিতে পাথরের সৈকত, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ডুলহাজারা সাফারিপার্কসহ কক্সবাজার জেলার পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় লেগেই আছে।
২. সুন্দরবন

সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সুন্দরবন, বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। এই সুন্দরবন বাংলাদেশের মুল পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি। এই বনভূমি গঙ্গা ও রূপসা নদীর মোহনায় অবস্থিত সমুদ্র উপকূল তথা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। ২০০ বছর পূর্বে সুন্দরবনের প্রকৃত আয়তন ছিলো প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কিলোমিটার যা কমে এখন ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। এই সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশ সীমানায়। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে স্বীকৃতি দেয়ায় সুন্দরবন এখন বিশ্ব মানবতার সম্পদ। ধারনা করা হয় সুন্দরী গাছের নামানুসারেই সুন্দরবনের নাম করন হয়েছে। এই বনে সুন্দরী গাছ ছাড়াও, গেওয়া, কেওড়া, বাইন, পশুর, গড়ান, আমুরসহ ২৪৫ টি শ্রেণী এবং ৩৩৪ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এই বিশাল অরণ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৯০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ টি প্রজাতির উভচরদের বাসস্থান রয়েছে। পৃথিবীর মোট ৩টি ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবন সর্ববৃহৎ। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও জীব-বৈচিত্র্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আবহমান কাল ধরে আর্কষন করে আসছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ,নদীর পাড়ে শুয়ে থাকা নোনা জলের কুমির এবং বানরের দল পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ করে।
৩. সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের শেষ স্থলভাগ। এই দ্বীপ টি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলে। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল,শামুক-ঝিনুক, সামুদ্রিক শৈবাল, গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, সামুদ্রিক মাছ, উভচর প্রাণী ও পাখি দেখা যায়। দ্বীপটি বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন তিনটি লঞ্চ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড (টেকনাফ) হতে আসা যাওয়া করে। এছাড়া টেকনাফ থেকে স্পীডবোটও চলাচল করে।
সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে বর্তমানে বেশ কয়েকটি ভালো আবাসিক হোটেল রয়েছে। একটি সরকারি ডাকবাংলো আছে। প্রবাল এবং স্ফটিক স্বচ্ছ জলের দ্বারা বেষ্টিত সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত দেখতে আর নিরিবিলি ঘুরে বেড়াতে পর্যটকরা এখানে আসেন। শহর জীবনের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের থেকে দূরে, এই দ্বীপের প্রশান্তি আর সামুদ্রিক নানা খাবার আপনাকে তৃপ্ত করবে।
৪. রাঙামাটি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা রাঙামাটি। কাপ্তাই লেকের বুকে ভেসে থাকা ছোট্ট জেলা শহর আর আশপাশে সর্বত্রই রয়েছে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় স্থান। এখানকার জায়গাগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজে। তবে বর্ষার সাজ একেবারেই অন্যরূপ।প্রকৃতির এই সকল রূপ উপভোগ করতে ঘুরে আসতে পারেন রাঙামাটির আকর্ষণীয় কিছু পর্যটন কেন্দ্র থেকে। রাঙামাটির দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে কাপ্তাই লেক, এই লেকের উপর রয়েছে বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রীজ, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, রাজবন বিহার আর রয়েছে শুভলং ঝরনা।
কাপ্তাই লেক
![]() |
কাপ্তাই লেক, রাঙামাটি জেলা, বাংলাদেশ |
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান
তের হাজার একর এলাকা নিয়ে কর্ণফুলী নদীর কোল ঘেঁষে কাপ্তাই উপজেলায় গড়ে উঠেছে ‘কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান’। সারি সারি পাহাড় আর প্রকৃতির অপুর্ব সমন্বয় ঘটেছে এখানে। এ বনভূমি বিচিত্র বন্যপ্রাণী ও পাখির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। বর্ষাকালে মেঘ পাহাড়ের মিতালি আর শীতে কুয়াশার লুকেচুরি - প্রকৃতির এমন কারুকাজ বেশ রোমঞ্চকর বৈকি। বনের ভেতর সারি সারি সেগুন, জারুল, গামার আর কড়ই গাছের মাঝ বরাবর পায়ে হেটে চলা পর্যটকদের অফুরন্তু আনন্দের খোরাক।
শুভলং ঝরনা
![]() |
শুভলং ঝরনা, রাঙামাটি জেলা, বাংলাদেশ |
রাঙ্গামাটি সদর হতে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে শুভলং বাজারের পাশেই শুভলং ঝর্ণার অবস্থান। বাংলাদেশের অন্য সকল ঝর্ণার মত শুভলং ঝর্ণাতেও শুকনো মৌসুমে পানি খুব কম থাকে। বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে বিপুল জলধারা কাপ্তাই লেকে আছড়ে পড়ে। এছাড়া শুভলং ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার পথের সৌন্দর্য্য আপনাকে আবেগময় করে তুলতে পারে।
৫. সাজেক ভ্যালি
![]() |
সাজেক ভ্যালি, রাঙ্গামাটি, বাংলাদেশ |
সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার কাসালং রেঞ্জের পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত, এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 1800 ফুট উঁচুতে। যারকারনে এটি রাঙ্গামাটির ছাদ হিসাবেও পরিচিত। সাজেক উপত্যকাটি খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে এবং রাঙ্গামাটি শহর থেকে ৯০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে। এটি ভারতের মিজোরাম থেকে মাত্র 8 কিলোমিটার দূরে। সাজেকের অপূর্ব সবুজ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রান্তর, মেঘের সাথে খেলার সুযোগটি এখানে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সাজেক উপত্যকার সৌন্দর্য নির্ধারণ করতে কোনও শব্দই যথেষ্ট নয়। করে। উপত্যকার শীর্ষে, আপনি আপনার চারপাশে বয়ে যাওয়া মেঘ দেখতে পাবেন এমনকি আপনি তাদের স্পর্শ করতেও পারেন। এই মনোরম সৌন্দর্য আপনাকে পৃথিবীতে স্বর্গের দৃশ্য অনুভব করবে।
এই এলাকার মধ্যে দিয়ে বয়েগেছে সাজেক নদী আর তার থেকেই এই উপত্যকার নাম হয়েছে সাজেক উপত্যকা। সাজেকে সর্বত্র মেঘ, পাহাড় আর সবুজ। সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে ট্রেকিং করে কংলাক পাহাড়-এ যাওয়া যায়। কংলাক হচ্ছে সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। কংলাকে যাওয়ার পথে মিজোরাম সীমান্তের বড় বড় পাহাড়, আদিবাসীদের জীবনযাপন, চারদিকে মেঘের আনাগোনা দেখা যায়। এখানে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে উপজাতিয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং তাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণ উপভোগ করা যায়।
৬. পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার
![]() |
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, নওগাঁ , বাংলাদেশ |
বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীর অন্তর্গত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুড় গ্রামে এই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার অবস্থিত। পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০.৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়সদৃশ স্থাপনা হিসেবে এটি টিকে রয়েছে। স্থানীয় লোকজন একে 'গোপাল চিতার পাহাড়' আখ্যায়িত করত। সেই থেকেই এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর, যদিও এর প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। মনেকরা হয় পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব (৭৮১-৮২১) অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন। পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে।১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়।
আয়তনে এই মহাবিহারের সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা করা যেতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন।খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
৭. মসজিদের শহর বাগেরহাট
মসজিদের শহর বাগেরহাট মূলত একটি বিলুপ্ত শহর। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত বাগেরহাট জেলার অন্তর্ভুক্ত বাগেরহাট শহরের একটি অংশ ছিল এই শহরটি। বাগেরহাট খুলনা থেকে ১৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঢাকা থেকে ২০০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। এই শহরের অপর নাম ছিলো খলিফতাবাদ এবং এটি শাহী বাংলার পুদিনার শহর নামেও পরিচিত ছিল। মনেকরা হয় ১৫শ শতকে তুর্কি সেনাপতি খান-ই-জাহান এই শহরটি গড়ে তোলেন। এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি; সম্পূর্ণ বাগেরহাট শহরটিকেই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো এই সম্মান প্রদান করে। "স্থাপত্য কর্মের একটি অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে যা মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বর্ণনা করে"। অঞ্চলটির দেখার মতো ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ অন্যতম। এটি ছাড়াও এই শহরের অন্যান্য আরও বেশ কিছু স্থাপনা মূল শহরের অংশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে খান জাহানের সমাধী, সিংগরা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি।
খান জাহানের সমাধি
খান জাহানের সমাধিটি একটি জলাশয়ের উত্তর তীরে অবস্থিত যাতে কুমির রয়েছে এবং জলাশয়টি ঠাকুর দিঘি নামে পরিচিত। এটি বর্গাকৃতি এবং খননের সময় উত্তলিত পদার্থ দিয়ে পাড় তৈরি করে তার উপর সমাধি তৈরি করা হয়েছে। পাড় থেকে প্রশস্ত ও উলম্ব ধাপ তৈরি করা হয়েছে যা দিয়ে জলাশয়ে যাওয়া যায়। সমাধিটি ৪৫ বর্গফুট জায়গার উপর স্থাপিত একটি একক গম্বুজ বিশিষ্ট কাঠামো। নির্দিষ্ট আকৃতির পাথরের পাঁচটি স্তর দ্বারা ভিত্তি (বেজমেন্ট) তৈরির পর ইটের দেয়াল দ্বারা মাজারের গঠন সম্পূর্ণ করা হয়।
ষাট গম্বুজ মসজিদ
![]() |
ষাট গম্বুজ মসজিদ , বাগেরহাট, বাংলাদেশ |
ঠাকুর দিঘি জলাশয়ের পূর্ব তীরে অবস্থিত ষাট গম্বুজ মসজিদ। এটি বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। অনেকে এই মত প্রকাশ করেন যে খান জাহান আলীই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদ নির্মাণের জন্য পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে।যদিও সে সম্বন্ধে লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮·৫ ফুট পুরু। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলান যুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। মসজিদের চার কোণায় ৪টি মিনার আছে। দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় টেরাকোটার কারুকার্য দেখা যায়। এটিই মূলত এই অঞ্চলের সবথেকে জনপ্রিয় স্থাপত্য।
নয় গম্বুজ মসজিদ
![]() |
নয় গম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট, বাংলাদেশ |
মসজিদ অভ্যন্তরে দুসারি পাথরের থাম দিয়ে মোট নয়টি চৌকো খন্ডে বিভক্ত । প্রতিটি খন্ডের উপর মসজিদের ছাদের নয় গম্বুজ নির্মিত।সামনের দিকে ৩টি মাঝে ৩টি এবং পেছনের দিকে ৩টি মোট নয়টি গম্বুজ। মসজিদটির সামনের দিকে মোট ৩টা দরজা রয়েছে।
সিংগরা মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে অগ্রসর হলে দেখা যাবে সিংগরা মসজিদ। এই মসজিদের একটিমাত্র গম্বুজ রয়েছে যা দৃঢ় ভাবে নির্মিত এবং প্রশস্ত গম্বুজ। খান জাহান আলির নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী অনুযায়ী গম্বুজটি পুরু দেয়ালের উপর দণ্ডায়মান এবং এর শীর্ষে রয়েছে বাঁকানো কার্নিশ।
এছাড়াও নিকটেই রয়েছে রনভিজয়পুর মসজিদ, ও চুনাখোলা মসজিদ, চাইলে সেগুলিও দেখে আসতে পারেন।
৮. মহাস্থানগড়
![]() |
মহাস্থানগড়, বগুড়া, বাংলাদেশ |
মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামেও পরিচিত ছিল। মৌর্য, গুপ্ত, পাল এবং সেন আমলেও এর বিশেষ প্রশাসনিক গুরুত্ব ছিল। বর্তমান বগুড়া জেলার করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে এটির অবস্থিত এই গড়। মহাস্থানগড় যেতে হলে শুরুতেই আপনাকে যেতে হবে বগুড়ায়। ঢাকা শহর থেকে বগুড়ার দূরত্ব প্রায় ২১৪ কিঃ মিঃ এবং বগুড়া থেকে মহাস্থানগড়ের দূরত্ব প্রায় ৯ কিঃ মিঃ।
মহাস্থান গড় বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র। এখানে বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন মাজার শরীফ, মানকালীর ঢিবি, স্কন্ধের কূপ, গোকুলমেধ, কালীদহ সাগর, শীলাদেবীর ঘাট, জিওৎ কুণ্ড ইত্যাদি।
গোকুলমেধ
গোকুল মেধ মহাস্থানগড় বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ২কি.মি দক্ষিণ পশ্চিমে একটি বৌদ্ধ স্তম্ভ রয়েছে যা সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। স্তম্ভের পূর্বার্ধে রয়েছে ২৪ কোন বিশিষ্ট চৌবাচ্চা সদৃশ একটি গোসল খানা। এটি বেহুলার বাসর ঘর নামেই বেশি পরিচিত।
কালীদহ সাগর
গড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবংগড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবং পদ্মাদেবীর বাসভবন।। কালীদহ সাগর সংলগ্ন ঐতিহাসিক গড় জড়িপা নামক একটি মাটির দূর্গ রয়েছে। প্রাচীন এই কালীদহ সাগরে প্রতিবছরের মার্চ মাসে হিন্দু ধর্মালম্বীদের রারুন্নী স্নান অনুষ্ঠিত হয়। স্নান শেষে পুণ্যার্থীগণ সাগরপাড়ে গঙ্গাপূজা ও সংকীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
শীলাদেবীর ঘাট
গড়ের পূর্বপাশে রয়েছে করতোয়া নদী এর তীরে ‘শীলাদেবীর ঘাট’। শীলাদেবী ছিলেন পরশুরামের বোন। এখানে প্রতি বছর হিন্দুদের স্নান হয় এবং একদিনের একটি মেলা বসে।
জিয়ৎ কুন্ড
এই ঘাটের পশ্চিমে জিয়ৎ কুণ্ড নামে একটি বড় কুপ রয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কথিত আছে এই কুপের পানি পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত। যদিও এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
৯. রাতারগুল
![]() |
রাতারগুল জলাভূমি বন, সিলেট, বাংলাদেশ |
সিলেট জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে, গোয়াইনঘাটে অবস্থিত, রাতারগুল জলাভূমি বন। রাতারগুল বাংলাদেশের একমাত্র মিঠা পানির জলাভূমি এবং বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি। একে বাংলাদেশের আমাজন এবং সিলেটের সুন্দরবনও বলা হয়। এই চিরসবুজ বনের সৌন্দর্য মূলত বর্ষাকালেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। এই বন বর্ষার সময় ভারতের পাহাড় থেকে আসা জল দ্বারা বন্যাকবলিত হয়।
অন্যান্য মরসুমে এটি শুষ্ক থাকে। এই বনের জল স্বচ্ছ এবং আপনি এই জলের মধ্য দিয়ে এই বনের নীচের স্তরটি দেখতে পাচ্ছেন। এখানে, জল-স্তর বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। বৃষ্টিপাত বেশি হলে 15-20 ফুট হতে পারে। এই জলাভূমির বনভূমির মোট আয়তন 3,325 একর। এই বনের প্রধান গাছগুলি হ'ল কোরোচ এবং হিজল। বানর, সাপ, ব্যাঙ এবং বিভিন্ন ধরণের পাখি এই বনে দেখা যায়। রাতারগুল দেখার সবচেয়ে ভাল সময় হ'ল বর্ষা। আপনি স্থানীয় কাঠের একটি নৌকা ভাড়া নিতে পারেন এবং সারা দিন এই অরণ্যের অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
চায়ের দেশ সিলেটে রাতারগুল ছাড়াও আশেপাশের জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলি হল বিছানাকান্দি, জাফলং, লভাছরা ও লালাখাল ইত্যাদি।
১০. লালবাগের কেল্লা
![]() |
লালবাগের কেল্লা , বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা |
লালবাগের কেল্লা বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। সম্রাট আওরঙ্গজেব তার শাসনামলে লালবাগ কেল্লা নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ শাহজাদা আজম ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রাসাদ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তৎকালীন লালবাগ কেল্লার নামকরণ করা হয় আওরঙ্গবাদ কেল্লা বা আওরঙ্গবাদ দুর্গ। পরবর্তীতে ১৬৮৪ খিষ্টাব্দে সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা ইরান দুখত পরীবিবি মারা যাওয়ার পর তিনি দূর্গটি তৈরির কাজ বন্ধ করে দেন। ১৮৪৪ সালে আওরঙ্গবাদ এলাকাটির নাম পরিবর্তন করে লালবাগ রাখা হয়। এলাকার নামের সাথে সাথে কেল্লাটির নামও পরিবর্তিত হয়ে লালবাগ কেল্লা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের বাসভবন ও দরবারটি ‘লালবাগ কেল্লা জাদুঘর’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এছাড়াও ঢাকা শহরের আশেপাশে দেখবার মতো জায়গাগুলি হল আহসান মঞ্জিল, শহীদ মিনার জাতীয় সংসদ ভবন, আরও কতো কি।
এছাড়াও বাংলাদেশে আরো অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। যেমন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, তাজহাট জমিদার বাড়ি, নিঝুমদ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, ছেড়াদ্বীপ, চিম্বুক পাহাড়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রাজবন বিহার, লাউয়াছড়া বন, চলনবিল, বান্দরবানের বোল্ডিং খিয়াং, রঙরাং পাহাড় ইত্যাদি। সময় ও সুযোগ হলে ঘুরে আসতে পারেন চমৎকার এইসব দর্শনীয় স্থানগুলো থেকে।
0 মন্তব্যসমূহ