ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ হাজারদুয়ারি ভ্রমণ। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ

ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী শহরটি ছিল মুর্শিদাবাদ। বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ান নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল। ১৭১৭ সালে মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজধানী করা হয় ১৭৫৭ সালে এই মুর্শিদাবাদেরই নিকট পলাশীর পলাশীর প্ররান্তরে হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নবাব সিরাজ উদ-দৌলার মধ্যে ঐতিহাসিক লড়াই, সেই ইতিহাস আল্পবিস্তর সকলেরই জানা। তবে, সে যাই হোক, ইতিহাসকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। হোক সে জয়-পরাজয়ের, গ্লানি অথবা বিশ্বাসঘাতকতার।  

 

এরপর বাংলার পূর্ণ শাসনভার  ব্রিটিশদের দখলে গেলে, বাংলার রাজধানীটি কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে মুর্শিদাবাদ হারিয়ে ফেলে তার কৌলীন্য। আজও সেই ঐতিহাসিক শহরের বিভিন্ন স্থাপত্য ও ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের সাক্ষ্য বয়ে ছলেছে। যার টানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসেন মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারী ভ্রমনে। বর্তমান হাজারদুয়ারি প্রাসাদ প্রাঙ্গণের মধ্যে যে কয়েকটি পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে তার মধ্যে ইমামবাড়া, একটি কামান ও টাওয়ার ঘড়ি উল্লেখযোগ্য। আর মূল প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক উপকরণ। তার বিস্তারিত বিবরন নিচে দেওয়া হল।


হাজারদুয়ারি প্রাসাদ

হাজারদুয়ারি প্রাসাদ
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ মুর্শিদাবাদ

মুর্শিদাবাদ ভ্রমনে এসে দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে পর্যটকরা সবার উপরে রাখেন হাজারদুয়ারী প্রাসাদকে। হাজারদুয়ারির অবস্থান মুর্শিদাবাদ জেলায় লালবাগ নামক অঞ্চলে ভাগীরথী নদীর তীরে। অনেকেই মনে করেন যে এই প্রাসাদ টি নবাব সিরাজ উদ-দৌলার তৈরি যা সত্য নয়। সিরাজের প্রাসাদের নাম ছিল হিরাঝিল, এখন তা ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মীরজাফরের বংশধর নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহের জন্য ব্রিটিশ স্থাপত্যকার ডানকান ম্যাকলিয়ড এটি নির্মাণ করেন। প্রায় ৪১ একর জায়গার ওপর তৈরি এই প্রাসাদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৮২৯ সালে আর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৩৭ সালে। বর্তমানে প্রাসাদটি হাজারদুয়ারী নামে পরিচিত হলেও হুমায়ুন জাঁ এর নাম রাখেছিলেন বড়কুঠি।

যে কারনে প্রাসাদটির নাম  হাজারদুয়ারী  অর্থাৎ ১০০০ টি দরজা, তার ৯০০ টি বাস্তবশত্রু আক্রমন করলে তাদের বিভ্রান্ত করতেই বাকি ১০০ টি নকল দরজা নির্মাণ করা হয়। অথচ দূর থেকে পুরোপুরি আসল বলে মনে হয়। ত্রিতল বিশিষ্ট প্রাসাদটির উচ্চতা প্রায় ৮০ ফুটপ্রাসাদে প্রবেশপথে সিঁড়ির দুইপাশে দুটি ছোট কামান রয়েছে, জানা যায় ইংরেজ সাহেব দের স্বাগত জানাতে এক্সম এতে তোপ দাগা হতো। তবে বর্তমানে সেগুলি অকেজো।

হাজারদুয়ারি মূল ফটক
হাজারদুয়ারি মূল ফটক

প্রাসাদটিতে  ১১৪ টি কক্ষ এবং ৮ টি গ্যালারী রয়েছে। এটি এখন একটি যাদুঘর এবং বাংলার নবাব, অভিজাত ব্যাক্তি, আর ব্রিটিশ দের ব্যাবহার করা নানা সৌখিন জিনিসের দুর্দান্ত সংগ্রহ রয়েছে এখানে। আলিবর্দি খাঁ ও নবাব সিরাজ উদ-দৌলার তলোয়ার, পলাশীর যুদ্ধে ব্যাবহৃত ঢাল, বল্লম, সহ নানা অস্ত্র সস্ত্র যার সংখ্যা ২৭০০এরও বেশি এমন কি মহাম্মদ বেগ সিরাজকে হত্যা করে যে ছুরি দিয়ে সেটাও রয়েছে এখানে

এই সুরম্য বিশাল রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে দেখা যায় রুপোর সিংহাসন যেটি ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী মহারানি ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার ১৬১টি ঝাড়যুক্ত বিশাল ঝাড়বাতির নীচে সিংহাসনে বসে নবাব দরবার পরিচালনা করতেন মন্ত্রণাকক্ষের লুকোচুরি আয়না, দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত বিশ্ববিখ্যাত সব ঘড়ি, মার্শাল, টিশিয়ান, রাফায়েল, ভ্যান ডাইক প্রমুখ ইউরোপীয় শিল্পীর অয়েল পেন্টিং, প্রাচীন সব পাথরের মূর্তি হাজারদুয়ারিকে বিখ্যাত করে তুলেছে প্রাসাদের ত্রিতলে আছে নবাবী আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন সোনা দিয়ে মোড়া কোরাণ শরিফ, অমূল্য পুঁথিপত্র, আইন--আকবরির পান্ডুলিপি সহ অসংখ্য বই ও মুল্যবান চিঠি পত্রের সম্ভার ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরও কিছু বিশিষ্ট নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে এই মিউজিয়ামে তবে দুর্বল কাঠামোর জন্য এখন দর্শকদের তিনতলায় উঠতে দেওয়া হয় না

সম্পূর্ণ জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে বেশ কিছু সময় লাগবে। টিকিট কেটে (ভারতীয়দের জন্য টাকা, এবং না-ভারতীয়দের জন্য ২০০ টাকা) আপনি ভিতরে যেতে পারেন। কিন্তু শুক্রবার মিঊজিয়াম বন্ধ থাকে


নিজামত ইমামবাড়া

নিজামত ইমামবাড়া , মুর্শিদাবাদ
নিজামত ইমামবাড়া বা বড় ইমামবাড়া

হাজারদুয়ারি প্রাসাদ প্রাঙ্গণের উত্তরপাশেই অর্থাৎ প্রাসাদের ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে নিজামত ইমামবাড়া বা বড় ইমামবাড়াএটি বাংলার তথা ভারতের সবথেকে বড় ইমামবাড়া। দ্বিতল বিশিষ্ট এই ইমামবরার দৈর্ঘ্য ৬৮০ ফুট। বলা হয়, প্রথমে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাই এটিকে কাঠ দ্বারা নির্মাণ করান। নির্মাণের প্রায় একশো বছর পর ১৮৪৬ সালে একবার এতে আগুন লেগে যায়। এতে সম্পুর্ণ ইমামবাড়াটি পুরে যায়। বাংলা তখন ব্রিটিশদের দখলে। মসনদে তাদেরই অধীনত নবাব হুমায়ু্মাণ জাঁর ছেলে নওয়াব নাজিম মনসুর আলী। ১৮৪৭ সালে মনসুর আলী ফেরাদুন জাঁ প্রায় সাত লাখ রুপি ব্যয়ে এই ইমামবাড়াটি তখন পুনর্নির্মাণ করেন।

মহরমের সময় এখানে প্রচুর জনসমাগম এবং পরব পালন হয়। যদিও এই অনুষ্ঠানের নবাবি আমলের জৌলুস আজ আর নেই। মহরম মাসের প্রথম দশদিন এখানে জাঁকজমকপূর্ণ মেলা হয়। এটি  মুসলমান ধর্মস্থান হলেও মহরমের সময়ে এই স্থান সকল ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। বছরের অন্যান্য সময়ে এই ইমামবড়া বন্ধ থাকে, ফলে আপনি শুধু বাইরে থেকেই দেখতে পারেন।

 

মদিনা মসজিদ

মদিনা মসজিদ, মুর্শিদাবাদ
মদিনা মসজিদ, মুর্শিদাবাদ


ইমামবাড়া ও হাজারদুয়ারি প্রাসাদের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি মদিনা মসজিদ। এর আকার বেশ ছোট। আসলে এটি মসজিদের আকৃতি বিশিষ্ট একটি ছোট ভবন। এটি মূলত হযরত মুহম্মদ (সা.) মদীনার রওজা মোবারকের অনুরূপ একটি প্রতিকৃতি।  

এটি সিরাজের সময়ের স্থাপত্যশিল্পের একমাত্র নিদর্শন। সিরাজ নিজে এই মদিনার জন্য কারবালা থেকে পবিত্র মাটি মাথায় করে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। মায়ের প্রতিজ্ঞা পালনেই তিনি এটি করেছিলেন। সিরাজের মা আমিনা বেগম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তার পুত্র নবাব হলে মদিনার পবিত্র মাটি এনে বহুমূল্যবান রত্ন দ্বারা এর দরজা প্রস্তুত করবেন। তবে, এটি কথিত। এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না।  

 

বাচ্চাওয়ালী কামান 

বাচ্চাওয়ালি তোপ
বাচ্চাওয়ালী কামান বা তোপ

হাজারদুয়ারি প্রাসাদের উত্তর দিকে মদিনার পাশেই রয়েছে একটি বিশাল কামান। এটিকে বাচ্চাওয়ালী কামান বা তোপ বলা হয়। নবাব হুমায়ূন ঝাঁর সময় এটি ভাগীরথী নদীর চর থেকে উদ্ধার করা হয়।  

১৬৪৭ সালে ঢাকার বিখ্যাত কর্মকার জনার্দন কর্মকার এটি তৈরি করেন। বিখ্যাত জাহান কোষা কামানও তিনিই তৈরি করেছেন। এর দৈর্ঘ ১৮ ফুট ও প্রস্থ ২২ ইঞ্চি। এর ওজন আনুমানিক ৭৬৭৫কেজি। জাহান কোষা কামান ছিলো মুর্শিদকুলি খাঁর আর এটি হচ্ছে সুলতান ইলিয়াস্ শাহর৷  কথিত রয়েছে, এই কামান একবারই শুধু দাগা হয়েছিল এবং কামানটি দাগার জন্য ১৮ কেজি বারুদ লেগেছিলএর তীব্র আওয়াজে তখন বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটে। সেই কারণেই এর নাম দেওয়া হয় বাচ্চাওয়ালি তোপ। এই ঘটনায় নবাব অত্যন্ত ব্যথিত হন। এর পরে কামানটি আর ব্যবহার হয়নি।  

 

এছাড়াও প্রাঙ্গনের ভিতর রয়েছে একটি উঁচু টাওয়ার ঘড়ি যা এখন সচল নেই। আগে বিরাট শব্দ করে এটি সময় জানান দিতো। সেই সঙ্গে নবাব বা ইংরেজ শাসকরা এলে ঘণ্টাও বাজানো হতো

 

টাওয়ার ঘড়ি, হাজারদুয়ারি, মুর্শিদাবাদ
হাজারদুয়ারি, মুর্শিদাবাদ


কীভাবে যাবেন

কলকাতা শহর মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী একটি বড়ো শহর কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ২০৪ কিলোমিটার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লোকাল, লালগোলা প্যাসেঞ্জার এবং এক্সপ্রেস ট্রেন করে মুর্শিদাবাদ যাওয়া যায় এছাড়া আপনি বহরমপুরে (মুর্শিদাবাদ জেলার সদর) বাসে করে এসে, সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ শহরে পৌঁছানোর জন্য একটি অটো রিক্সা বা গাড়ি ভাড়া করতে পারেন হাজারদুয়ারি বহরমপুর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার

কোথায় থাকবেন

হাজারদুয়ারি প্রাসাদ প্রাঙ্গনের বাইরেই বেশকিছু থাকবার মতো ছোট ছোট ঘর আছে।  এগুলিকে হোটেল বললে ভুলই হবে, কেবল রাত্রি  যাপনের জন্য যথেষ্ট। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ