কৃষ্ণনগর মানে ঐতিহ্য আর বনেদিয়ানার মেলবন্ধন। এই শহরের অলিগলিতে মিলবে অতীতের কিছু অন্ধকার আর কিছু গৌরবময় ইতিহাসের কথা। আর কৃষ্ণনগর বলতেই যা মনে আসে তা হল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল আর এখানকার সরপুরিয়া আর সরভাজার। শোনা যায়, এই দুই মিষ্টি আবিষ্কার করেছিলেন কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মিষ্টান্ন কারিগর অধরচন্দ্র দাস। কৃষ্ণনগর বাংলার অন্যতম শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর বলে পরিচিত, বর্তমানে এটি নদীয়া জেলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ও সদর শহর।

প্রথমেই আসি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কথায়
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির খোলা থাকে বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে। বছরের কিছু বিশেষ তিথিতে কেবল জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে এই রাজবাড়ি-নাটমন্দির। দুর্গা পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো ছাড়া বারোদোলের সময় খোলা থাকে রাজবাড়ি। কৃষ্ণনগরের বারদোলের মেলা বাংলার অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মেলা। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই মেলার প্রবর্তক।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বারো ভুঁইয়া দমনে, বিশেষ করে প্রতাপাদিত্যর পতনে মুঘলদের সাহায্য করবার পুরস্কার হিসেবে ভবানন্দ মজুমদার সম্রাট জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে এক বিরাট তালুক লাভ করেন৷ তাঁকেই বলা হয় নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা৷ প্রথমে বাগোয়ান গ্রামে রাজধানী স্থাপন করেন ভবানন্দ, পরে ভবানন্দের পৌত্র রাঘব রায় মাটিয়ারি থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন ‘রেবতী’ গ্রামে৷
![]() |
রাজবাড়ির দুর্গাদালান |
জনশ্রুতি, কৃষ্ণের অগ্রজ বলরামের স্ত্রী রেবতীর নাম অনুসারেই ওই গ্রামের নামকরণ হয় রেবতী পরে লোকমুখে তা ‘রেউই’ হয়ে যায়৷ রাঘব রায়ের পুত্র রুদ্র রায় ছিলেন পরম কৃষ্ণভক্ত তিনি শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে রেউই গ্রামের নামকরণ করেন ‘কৃষ্ণনগর’৷ তিনি ঢাকা থেকে আলাল বক্স নামে এক স্থপতিকে আনিয়ে তৈরি করান চকবাড়ি, কাছারিবাড়ি, হাতিশালা, আস্তাবল, নহবৎখানা এবং পঙ্খ অলঙ্কৃত দুর্গাদালান এসব নির্মান করান। এর বিচিত্র কারুকার্য যেকোনো ব্যক্তির মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
রুদ্র রায়ের প্রপৌত্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭২৮ সালে নদীয়ার রাজা হন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। তাঁর রাজত্বকালেই ফুলে ফেঁপে ওঠে রাজ্য। তাঁর আমলকে ‘নদীয়ার স্বর্ণযুগ’ বলা হয়৷ ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর মাঠে, ইংরেজদের কাছে সিরাজের হারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সুর্য অস্তমিত হয়। জগৎ শেঠের নেতৃত্বে সিরাজকে সরানোর যে চক্রান্ত শুরু হয় তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এই রাজবাড়ি। সিরাজের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রকারীদের দলে সামিল হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র।
শোনা যায়, ব্রিটিশ সরকারকে পত্রযোগে পরামর্শদান করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশকে সৈন্য দিয়েও সাহায্য করা হয়েছিল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকেই। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ তিনি ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। দুর্ভাগ্যবশত নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেন মীর কাশেম।
১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট দেশ স্বাধীন হলেও কৃষ্ণনগর সহ গোটা নদীয়া সেইদিন আনন্দ উৎসবে সামিল হতে পারেনি।নদিয়া ছাড়াও মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও পশ্চিম দিনাজপুর এই চারটি জেলার এবং বনগাঁ থানা এলাকার মানুষ স্বাধীনতার আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে পারেননি সেদিন। ভারত না পাকিস্তান – কোন দেশের মধ্যে তাঁরা থাকবেন এই অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন কাটছিল কৃষ্ণনগর সহ গোটা নদীয়াবাসীর।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় আঁকা মানচিত্রকে ভিত্তি করে দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, যশোহর এবং বনগাঁকে ‘পূর্ববঙ্গে’র মধ্যে ধরা হয়। ১৪ অগস্টের বেতার বার্তায় কৃষ্ণনগর ও রাণাঘাট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে শুনে সবার মাথায় হাত পড়ে যায়। রেডিওর ঘোষণা শেষ হতেই, এলাকাজুড়ে উড়ল পাকিস্তানের পতাকা। এদিকে কৃষ্ণনগরের রানি জ্যোতির্ময়ী দেবী ইংরেজদের এই কাজ মেনে নিতে পারলেন না। পুত্র সৌরীশ ও কয়েকজন পার্ষদকে নিয়ে দেখা করলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে। তবে রানির পত্রের কারনেই হোক বা অন্য কোনও কারনে শেষ পর্যন্ত রানির আশাই পূর্ণ হয়। ১৭ অগাস্ট রাতে রেডিওতে ঘোষণা হল যে, কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট ভারতেই থাকছে। উল্লাসে ফেটে পড়লেন এলাকার মানুষ। সেই হিসাবে, ১৮ অগস্ট স্বাধীন হল কৃষ্ণনগর।
কৃষ্ণচন্দ্র রায় রাজবাড়ির দুর্গাদালানে মহা সমারোহে পারিবারিক দুর্গাপুজো করতেন। তিনিই শুরু করেছিলেন কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো ৷ তার হাত ধরেই এই পুজো জনপ্রিয় হয় ৷ চন্দননগরের পুজো এর অনেক পরে শুরু ৷ এরপর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রিয়তা পেয়েছেন মা জগদ্ধাত্রী ৷ রাজবাড়ির দুর্গার প্রচলিত নাম রাজরাজেশ্বরীর। উল্টোরথের পরের দিন পাটপুজোর মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের কাজ।এখানে তিনি যুদ্ধের বেশে সজ্জিত। প্রতিমার সাজ প্রচলিত ডাকের সাজের চেয়ে আলাদা। একে বলা হয় ‘বেদেনি ডাক’।
কৃষ্ণচন্দ্র একজন সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি রায়গুনাকর ভারতচন্দ্র ছিলেন তাঁর সভাকবি। এ ছাড়া সাধককবি রামপ্রসাদ সেন, পন্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করেন। রাজা বিক্রমাদিত্যের মত তাঁর রাজসভাও অলঙ্কৃত করতেন নবরত্ন। নবরত্ন সভার মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়। দরবারের প্রখ্যাত বিদূষক গোপাল প্রামানিক ওরফে গোপাল ভাঁড় ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্রের পরামর্শদাতা।
কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে আঠারো শতকের মধ্যভাগে ভারতচন্দ্র তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য’ রচনা করেন। কথিত আছে, দেবী অন্নপূর্ণার স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী তিনি ভারতচন্দ্রকে দিয়ে দেবীর মাহাত্ম্যসূচক এ কাব্য রচনা করান। কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। তৃতীয় খন্ডের নাম মানসিংহ। এতে কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের ইতিহাস, মানসিংহ কর্তৃক প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করার কাহিনী এবং অন্নদার মহিমা বর্ণিত হয়েছে।
নবদ্বীপ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতচর্চার ক্ষেত্রে কৃষ্ণচন্দ্রের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সংস্কৃতচর্চা বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন এবং এজন্য প্রচুর অর্থও ব্যয় করেন। নদিয়ার বাইরে সুদূর বিক্রমপুর ও বাকলার পন্ডিতগণও তাঁর অর্থানুকূল্য ভোগ করতেন। তিনি নদিয়ায় অনেক টোল ও চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন এবং সেগুলির ব্যয়ভার বহনের জন্য করমুক্ত ভূসম্পত্তি দান করে সংস্কৃতচর্চার পথ প্রশস্ত করেন। সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য নদিয়ায় আগত বিদেশী ছাত্রদের জন্য তিনি মাসে দু’শ টাকা মাসোহারা দেবারও ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী রানী ভবানীও সে যুগে বাংলাদেশে সংস্কৃতচর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন বাংলায় সঙ্গীতেরও যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে সেখানকার উচ্চ সাঙ্গীতিক পরিবেশের কথা জানা যায়। এসব ছাড়াও কৃষ্ণচন্দ্র বহু জনহিতকর কাজও করেছেন। ১৭৬২ সালে নদীয়া জেলার শিবনিবাসে তিনি একটি বৃহৎ শিবমন্দির নির্মাণ করেন এবং বাংলায় তিনিই প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন।
ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে সেখানকার উচ্চ সাঙ্গীতিক পরিবেশের কথা জানা যায়। এসব ছাড়াও কৃষ্ণচন্দ্র বহু জনহিতকর কাজও করেছেন। ১৭৬২ সালে নদীয়া জেলার শিবনিবাসে তিনি একটি বৃহৎ শিবমন্দির নির্মাণ করেন এবং বাংলায় তিনিই প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। তাঁর উৎসাহ ও উদ্যোগে নাটোরের কয়েকজন বিখ্যাত মৃৎশিল্পী কৃষ্ণনগরে গিয়ে মৃৎশিল্পের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটান। যা আজকে ঘূর্ণি নামে পরিচিত। তবে নদীয়া কাহিনীর রচয়িতা কুমুদ নাথ মল্লিকের মতে শিল্পীরা বাইরের নন, তারা স্থানীয়। পূর্বে তারা কুমোর ছিলেন পরবর্তীকালে খ্রিষ্টান মিশনারি ও ইংরেজ শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতায় মাটির পুতুল বানানো শুরু করেন।
গোপাল ভাঁড়
কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামের সাথে যার নাম ওতপ্রোত ভাবে জরিয়ে আছে সে হল গোপাল ভাঁড়। প্রায় দুইশত বছরেরও অধিক আবহমানকাল ধরে প্রচলিত তার জীবন-রস সমৃদ্ধ গল্পগুলো পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে, লোককথায় এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে। কতগুলি গল্প প্রায় প্রবাদের ন্যায় ব্যবহৃত হয়। তাকে মোল্লা নাসিরুদ্দিন ও বীরবলের সমতুল্য হিসাবে পরিগণনা করা হয়।
তবে গোপাল ভাঁড় চরিত্রটি ঐতিহাসিক, গবেষক ও ভাষাবিদদের কাছে বিতর্কের বিষয় বহুকাল থেকে। গোপালের গল্পগুলি সমাজে চুড়ান্ত জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত হলেও গোপাল ভাঁড় বাস্তবে ছিলেন কিনা সে নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকেই মনে করেন গোপাল ভাঁড় নামে কেউ নির্দিষ্ট করে ছিলেননা। তবে কোনো না কোনো বিদূষক রাজার প্রিয়পাত্র হন। সেরকম গোপাল নাম্নী নাপিত বংশীয় কোনো ব্যক্তি ছিলেন। গোপালের জন্ম কত বঙ্গাব্দে তা কোথাও লেখা নেই। তার জন্মস্থানের পক্ষেও কোনো নথি নেই, কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা হিসেবে তার সম্পত্তির কিংবা জায়গা-জমির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। নবদ্বীপ কাহিনি বা ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়’ বইটির লেখক নগেন্দ্রনাথ দাসের মতে গোপালের পদবী ছিল ‘নাই’। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে রাজভাণ্ডারি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গোপালচন্দ্র ভাণ্ডারি হাস্যার্ণব উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ওই ভাণ্ডারি শব্দটিরই অপভ্রংশ থেকে ভাঁড় হয়ে গেছে।
ঘূর্ণির মৃৎশিল্প
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল জগৎ বিখ্যাত। শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে এখানকার পুতুল। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও তার কদর যথেষ্ট। সাধারণ মানুষ কিংবা মনীষীদের অবিকল প্রতিকৃতি নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারেন ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীরাই৷ প্রতিটি মাটির পুতুলে মুখের চামড়া, দেহের পেশীর ভাঁজ,কালো চুলের মাঝে পাকা চুল কিংবা চোখের মনি যে ভাবে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা তা দেখার মতো ।
![]() |
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল |
১৮৫১ সালে লণ্ডনে ‘এগজিবিশন অব দ্য ওয়ার্কস অফ ইন্ডাস্ট্রিজ অফ অল নেশনস’ প্রদর্শনীতে স্থান পায় ঘূর্ণির শিল্পী শ্রীরাম পালের শিল্পকর্ম। সেই শুরু তারপর থেকে আজও সেই ইতিহাসের ব্যতিক্রম হয় নি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বারবার নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীরা।
তবে ধীরে ধীরে এই শিল্পকর্ম বিপন্ন হওয়ার মুখে, আগের তুলনায় শিল্পীদের সংখ্যাও কমেছে যথেষ্ট। মৃৎশিল্পীদের পরিবারগুলোর নতুন প্রজন্ম আর মাটির কাজে আগ্রহী হচ্ছেন না। এর বদলে তারা অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পরছেন। এর প্রধান কারন হল মাটির পুতুল তৈরি করতে যে সময় ও পরিশ্রম লাগে আর পুতুল বিক্রি করে যে আর্থিক লাভ হয় তা শিল্পীদের চাহিদা পূরণে ব্যার্থ। তাই অনেকেই পুতুলের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পুতুল গড়ার কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন।
এছাড়াও একটি বড় সমস্যা হল জলঙ্গি নদীর পাড় ভাঙ্গন, এর জন্য পুতুল গড়ার মতো উপযুক্ত মাটি এখন সহজলভ্য নয়। তাই অনেকে প্লাস্টার অফ প্যারিস ও ফাইবার গ্লাস এর পুতুল বানাচ্ছেন।
সবশেষে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মিষ্টি সরপুরিয়া ও সরভাজার কথা
সরপুরিয়ার ঐতিহাসিকতা নিয়ে মতভেদ আছে। চৈতন্যদেব তিন প্রকারের সরের মিষ্টান্ন খেতেন। তার মধ্যে অন্যতম সরপুপী বা সরপুরিয়া। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃততে এর উল্লেখ আছে। অদ্বৈত আচার্য নিজেই চৈতন্যদেবকে সরপুরিয়া পাঠাতেন।
![]() |
সরপুরিয়া |
অন্যদিকে প্রচলিত মতে সরপুরিয়ার সৃষ্টিকর্তা কৃষ্ণনগরের অধরচন্দ্র দাস। আবার মতান্তরে সরপুরিয়ার সৃষ্টিকর্তা তারই পিতা সুর্যকুমার দাস। কথিত আছে যে তিনি রাতে ছানা, ক্ষীর ও সর দিয়ে তৈরী করতেন সরপুরিয়া। পরের দিন সকালে মাথায় করে নিয়ে ফেরি করতেন। যুবক অধরচন্দ্র তার পিতার কাছে মিষ্টি তৈরী কৌশল শিখে নেন।
সরভাজা হল কৃষ্ণনগরের অপর একটি বিখ্যাত মিষ্টি। দুধের সর ও ঘি দিয়ে তৈরি এই মিষ্টির সুনাম বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো ছাড়াও কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোতে সরভাজার চাহিদা অন্য সময়ের থেকে বেশি থাকে।
![]() |
কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মিষ্টি সরভাজা |
মিষ্টি তৈরির এই গোপন পদ্ধতি যেন ফাঁস না হয়ে যায় সেই কারণে অধরচন্দ্র দাস, বাড়ি ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে খুব গোপনে সরভাজা তৈরির পাক তৈরি করতেন। কিন্তু সে খবর ঠিকই ছড়িয়ে পড়ত শহরে। কথিত রয়েছে, মাছির ঝাঁক তখন ঘিরে ধরত অধরচন্দ্র দাসের বাড়ি।
এই মিষ্টি কিন্তু খুব বেশি প্রাচীন নয়। মাত্র একশো বছর আগের কথা। তখনই এই মিষ্টিকে ঘিরে কৃষ্ণনগরের আরও একটি পরিচয় তৈরি হচ্ছিল আস্তে আস্তে। তারপরে সেই মিষ্টি সত্যিই কৃষ্ণনগরের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। মাটির পুতুল, জগদ্ধাত্রী পুজো, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের কথার সঙ্গে সঙ্গে সরপুরিয়া, সরভাজার কথাও ছড়িয়ে পড়ছিল। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সে কথা বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। নানা দোকানেই তৈরি হতে থাকে সরপুরিয়া, সরভাজা। শহরের নেদেরপাড়ায় অধরবাবুর পরিবারের লোকেরাই দু’টি মিষ্টির দোকান করেন। শহরের আরও কিছু দোকানেও এই মিষ্টি তৈরি করা শুরু হয়ে যায়।
১৯০২ সালে নেদের পাড়ায় অর্থাৎ বর্তমান অনন্তহরি মিত্র রোডে প্রতিষ্ঠা করেন মিষ্টির দোকান। দোকানের নাম অধরচন্দ্র দাস। কালক্রমে এটি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ